
তবে কি আওয়ামী স্রোতের শেষ এখানেই, নাকি নতুন বাঁকের অপেক্ষায় দেশের রাজনীতি? কারণ দেড় দশকের দুঃশাসনের মহানেত্রী ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা পতনের বেশ পরে তার গণতন্ত্র হত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিল প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ।
এর আগে এ বিষয়ে বিচ্ছিন্ন দাবি, ফিসফাস কথাবার্তা এবং সর্বসম্প্রতি ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপিসহ কিছু সংগঠন ঢাকা শহরে আন্দোলন করলে সরকার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে।
এ সিদ্ধান্ত এমন একসময়ে নেওয়া হলো, যখন দলটির একটি ‘রিফাইন্ড ভার্শন’ চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল বলে শুনেছি। এখন হয়তো ভিন্ন নামে, ভিন্ন কায়দায় তা করা হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি ও ইতালিতে মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী দলকে মতাদর্শিক ও আইনগতভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে রাখতেও এতসব ‘প্যাঁচ গোছ’-এর প্রয়োজন পড়েনি, যত জটিলতা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে।
পাঠকের কাছে প্রশ্ন রাখি— জুলাইয়ের রক্তঝরা, দম বন্ধ হওয়া দিনগুলোয় অথবা ঠিক ৫ আগস্ট সারা দেশের রাস্তায় জনতাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো— আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মী এবং তাদের দলের রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার আছে কিনা, কী উত্তর পেতাম আমরা?
কৃত অপরাধ সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন আওয়ামী লীগের পুরো বহর বিদ্যুৎ বেগে উধাও হয়ে যায় সেদিন এবং অতঃপর অনেকেই ‘হিজরত’ করেন তাদের জন্য নিরাপদ ভূমিতে।
কোটি জনতার রক্তাক্ত প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ সরকার ও দলের সরাসরি পরাজয় সত্ত্বেও দলটিকে নিষিদ্ধ করা ‘দূর কি বাত’, এ বিষয়ে আলোচনাটাও ‘জায়েজ’ কিনা তা নিয়ে সুশীল সংশয় ছিল কদিন আগেও।
হাজার অন্যায় থাক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলে কথা! সেই যুক্তি মোতাবেক আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী সব দলই তো নিষিদ্ধ হওয়ার কথা।
সুতরাং কিছু লোক বলতেই পারেন— ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে দেশের সবচেয়ে পুরোনো ‘ঐতিহ্যের’ অধিকারী দলটির, হোক না তা দুই-চার মেয়াদের স্বৈরতন্ত্রের।
একদলীয় বাকশাল কায়েম করা দলটিই ফেরত এসেছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে।
জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের আওয়ামী হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হওয়ার আগেই বাজারে কথা ওঠে— কী করে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করে ‘নতুন বোতলে পুরাতন মদ’ ঢালা যায়।
সেসব কারণেই হয়তো ইদানীং আওয়ামী বয়ান নিয়ে নতুন করে ভার্চুয়াল জগতে মাথা জাগাচ্ছিলেন কিছু আওয়ামী নিদ্রাচারী ও পলাতক আসামি। বলা তো যায় না, যদি তাদের ‘হাসু আপা আবার আইস্যা পড়তেন’, তখন তো এটাই হতো সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
তাদের সাহস জোগায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকার যুক্তি এবং তাকেসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য এদিক-সেদিকের তাগিদ।
এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা কাউন্সিলেরও কেউ কেউ ছিলেন দ্বিধান্বিত: দেশের ২৫-৩০ শতাংশ মানুষ যেহেতু আওয়ামী লীগ সমর্থন করে, কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আগে তাদের অবস্থান ও জনমত নিয়ে চিন্তা করা জরুরি। বন্ধুগণ, ইস্যুটি নৈতিকতার, সংখ্যাতাত্ত্বিক রাজনীতির নয়।
অবশ্য সংখ্যাতাত্ত্বিক এ অনুমানটিও যদি ঠিক থাকত, তাহলে শেখ হাসিনা নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের পথ বেছে নিয়েছিলেন কোন দুঃখে, তা বোঝা মুশকিল।
আমরা হয়তো খেয়াল করিনি বেপরোয়া আওয়ামী সমর্থকরা আসল ‘মার’টা খেয়েছে বিপ্লবের তোড়ে ক্ষুদ্রতম সংখ্যায় পরিণত হয়েই; তারা নৈতিকভাবে হেরেছিল তিন-তিনটি চরদখলের নির্বাচন করে (যা তারা করেছিল হেরে যাওয়ার ভয়ে)।
আওয়ামী ভোটব্যাংকের হিসাব সঠিক হয়ে থাকলে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হতো না। তার মানে আওয়ামী বলয় সংকুচিত হয়েছিল ক্ষমতা হারানোর অনেক আগেই।
আওয়ামী শিবির এ হিসাব ভালোই জানে, হয়তো মানে না, কিন্তু বিরোধীরা আওয়ামী লীগকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। অন্যদের এই দুর্বলতাই হয়তো আওয়ামী রাজনীতির স্বপ্নচারীদের আশাবাদী করে ফেলেছিল।
আশাবাদ আসলেই খুব ভালো জিনিস। কারণ আওয়ামী সমর্থকগোষ্ঠী আগামীতে জড়ো হতে পারে এককাতারে, তার দলীয় যা-ই হোক।
তবে ১৯৭৫-এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পতন হওয়া বাকশালরূপী আওয়ামী লীগ ২১ বছরে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছিল যেসব কারণে, সেগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক।
প্রথমত ‘৭৫-এ আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয় এবং বাকশালে হারিয়ে গেলেও মুজিব পরিবারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘ভিকটিম কার্ড’ খেলতে থাকেন হাসিনা এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল একটি বিশাল মধ্যবয়সি এবং তরুণ প্রজন্ম মাঠে সক্রিয় ছিল। আজকে তিনি দীর্ঘ অত্যাচার, অবিচার, গুম-খুনের নেতৃত্ব দেওয়ার ধারাবাহিকতায় জুলাই ২০২৪-এর গণহত্যার এক নিষ্ঠুর খলনায়িকা।
দ্বিতীয়ত ২০২৪-এ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে পলায়নের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল ‘ভোট ও ভাতের রাজনীতি’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র মতো গালভরা বয়ান নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে। এ মুহূর্তে প্রতিশোধ ছাড়া অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই আওয়ামী রাজনীতির, যা হাসিনা নিজেই প্রমাণ করে গেছেন।
তৃতীয়ত এবারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি এবং জণগণের সব ধরনের অধিকার পদদলিত করে আওয়ামী রাজত্ব বাংলাদেশের আপামর জণসাধারণকে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করে দলটি থেকে। সেই মানুষই সে রকম দলকে রিব্র্যান্ডিং হলেও খুব সহজে বিশ্বাস করবে, এমন আশা দুরাশামাত্র।
চতুর্থত আওয়ামী লীগ অস্বীকার করতে পারবে না যে, এর নেতৃত্ব ক্ষমতায় টিকে ছিল ভারতীয় আশীর্বাদে এবং তারা সেবাও করেছে ভারতকে। দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে পুরো একটি তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘দিল্লি-আওয়ামী লীগ মৈত্রী’ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র হিসেবে চিহ্নিত। তাদের নতুন দল এই লিগ্যাসির বাইরে যাবে কী করে? দিল্লি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণে উদ্বেগ প্রকাশ করে সে প্রমাণই দিল।
পঞ্চমত লাখ লাখ দলীয় কর্মী-সমর্থনকদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে হাসিনা এবং শেখ পরিবারের সব ‘হোমরা চোমরা’ নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করে, যা দলের মাঠপর্যায়ে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। পুত্র জয় মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব পরিষ্কার করে দিলেন। তারা সবাই কেন পুরোনো আওয়ামী নেতৃত্বের পাশেই দাঁড়াবে তা বোধগম্য নয়।
এত কিছুর পরও যারা শুধু অনুশোচনাহীন ও নির্বিকারই নয়, বরং আওয়ামী লীগের তথাকথিত সেক্যুলার রাজনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে, দল নিষিদ্ধের পর তাদের আরেকটি ফাইনাল পরীক্ষা হবে আগামী নির্বাচন।
সেই নির্বাচনে ভোটাররা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে বা কোন দিকে হেলে পড়বে সে বিষয়ে আমাদের যে অনুমান তা দেশে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ২০০১ সালের ফলের ভিত্তিতেই। পরের দুই দশকে জনমিতির বণ্টন এবং ভোটারদের মেরুকরণ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য উপাত্ত নেই আমাদের কাছে। কারণ সে রকম নির্বাচনই হতে দেওয়া হয়নি এ দেশে।
ধরা যাক, একটি মুক্ত পরিবেশে আগামী নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) (এবং ক্ষুদ্র মিত্ররা) পেল ১৮০টি, জামায়াত ৩৫টি এবং অন্যান্য ইসলামি দল ৫টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ২০টি (যদি জনপ্রিয় রাজনীতিকদের প্রার্থী করতে পারে) এবং বিএনরাপির বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩৫টি।
আহ! এত কম আসন অবশিষ্ট থাকবে ভিন্ন নামের আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের জন্য?
যতদূর জানি, ১৯৭৩ থেকে এখন পর্যন্ত দলটি একবারও হারেনি এমন আসনের সংখ্যা মাত্র ৭টি। যা একটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকের ভাষায়— ‘ভিক্ষার সিট’। তার সঙ্গে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আঞ্চলিক সমীকরণ মিলিয়ে আরও ৮টি, আওয়ামী স্বতন্ত্রটি এবং আওয়ামীঘেঁষা বাম ও জাতীয় পার্টি মিলে আরও ৫টি পেলে শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট দলটির অনুকূলে থাকে বড়জোর ২৫টি বা মোটামুটি ৮ শতাংশ আসন; অর্থাৎ সংসদের চতুর্থ বৃহত্তম শক্তি, যা বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার অযোগ্য।
সে রকম দৃশ্য কল্পনা করে নির্বাচনের আগেই নতুন লীগের সম্ভাব্য নতুন মুখ তো বটেই মাঠপর্যায়ের অনেক কর্মী-সমর্থকই নবগঠিত দলটির মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ হবে না নিশ্চয়ই।
আর নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীরা যদি উল্লিখিত অনুমানের কাছাকাছি ফল দেখতে পায়, তখন তাদের মনে হতে পারে— জণগণকে ভোট দিতে না দিয়ে শেখ হাসিনা উচিত কাজই করেছিলেন! আর সেই বাস্তব নির্বাচনী ফল হবে স্বর্গ হারানো লোকেদের জন্য ৫ আগস্টের পর দ্বিতীয় ট্রমা।
এখন আওয়ামী লীগের যারা বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা নিয়ে নির্বাসিত বা আত্নগোপনে জীবনযাপন করছেন, তাদের এবং রাজনৈতিক কল্পনাবিলাসীদের উদ্যম ও তেল কমতেই থাকবে দিনে দিনে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করা অত্যাচারী দলটিকে নতুন মোড়কেও তারা গদিতে বসাবে, যাতে আবারও আওয়ামী দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা পেতে পারে, জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করা প্রজন্ম বোধহয় ততটা নির্বোধ নয়।