
রাজধানীর গ্রাফিকস আর্টস ইনস্টিটিউটের পঞ্চম পর্বের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমানকে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতনের পর মৃত ভেবে ফেলে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে। গত ১৫ মে রাতে এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
বুধবার রাতে নিজের উপর অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি ছবি পোস্ট করেছেন ভুক্তভুগী শিক্ষার্থী। পাঠকদের জন্য আতিকুর রহমানের পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আমি আতিকুর রহমান গাল্টু। গ্রাফিক্স আর্টস ইনস্টিটিউটের ৫ম পর্বের শিক্ষার্থী। গত ১৫ মে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১১.০৫ মিনিট পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, ছাত্রদল নেতা মাহী ও কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি তার মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমি বলেছি, আমি কেবল ডিউটি থেকে আসছি। খুব ক্লান্ত এখন আসতে পারবো না।
কালকে সকালে আসি? কিন্তু তারা বলেন, এখনই আসতে হবে। খুব জরুরি কথা আছে। কোনো সমস্যা হবে না।’
‘আমি আবার বললাম, আমার ফ্যামিলি টেনশন করবে। তারপরও তারা আমাকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। পরে আমি ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখি আমার সহপাঠী দুজন ও ১৩/১৪ জন সিনিয়র ভাই বসে আছেন। আমি যাওয়া মাত্রই তারা আমাদেরকে নানা কৌশলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলেন, আমরা ছাত্রলীগ করি ও হলে একটি মোবাইল হারিয়ে গেছে, সেই মোবাইল নাকি আমরা নিয়েছি। তারা বলেন, কে নিছস তোরা এখন বল।’
12345678
‘এক পর্যায়ে ওরা ৩ জনকে আলাদা রুমে নিয়ে বলেন, টিটু ও শাওন বলেছে আমি নাকি ফোন নিয়েছি, ওরা স্বীকার করেছে। আবার ওদেরকে বলে আমি স্বীকার করেছি টিটু ও শাওন মোবাইল নিয়েছে। বিনা কারণে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নানা কৌশলে রাতভর এবং শুক্রবার জুম্মা বিকেল তিনটা পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়।’
‘এর মধ্যে আমি ৩ বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। এর মাঝে যখন আমি জ্ঞান ফিরে পাই আমি খুব বিব্রতকর অবস্থায় ছিলাম এবং যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। তাদেরকে তখন হাতে-পায়ে ধরে বলি, আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি তাহলে কর্তৃপক্ষ এবং আমার পরিবারকে জানান। তারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন- আমি সেটাই মেনে নিব। আমি আপনাদের ছোট ভাই, আপনারা আমার ইনস্টিটিউটের বড় ভাই; আপনাদের ছোট ভাই মনে করে আমাকে আর মারবেন না। আমার গায়ে হাত দিয়েন না, আমার বাবা নেই, আমি এতিম- আমার মা বড় অসহায়। আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মা সহ্য করতে পারবেন না। দয়া করে আমাকে আর মারবেন না। আমি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।’
‘কিন্তু তারপরও তারা না শুনে একের পর এক অত্যাচার করেই যেতে থাকে। একটা সময় আমি একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরবর্তী দিন আমি বারোটার দিকে জ্ঞান ফিরে পাই। তখন দেখি যে রুমের দরজা খোলা। কিন্তু আমি আশেপাশে কাউকে দেখিনি। আমার মোবাইল থেকে শুরু করে সকল কিছু নিয়ে যাওয়ায় আমি কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। ক্লান্তিতে আমি উঠতেই পারছি না। আমি ওভাবেই পড়েছিলাম তিনটা পর্যন্ত।’
‘একটা সময় দেখি যে আমার সাথে একজন সহপাঠী, যে অত্যাচারিত হয়েছে। ও রুমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ভেবেছে আমি মনে হয় মারা গেছি। আমার অচেতন অবস্থা দেখে ও কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমি অল্প অল্প চোখ খুলছিলাম।
এমন সময় রুমে কেউ না থাকায় ওর কাঁধে ভর দিয়ে অন্য এক ক্লাসমেটের রুমে নিয়ে যায়। আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে বলে। সেখানে আমার কিছু সহপাঠী উপস্থিত ছিল। আমার ফোন না থাকায় ওরা ওদের ফোন দিয়ে আমার ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করেছে।’
‘পরে তারা ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে আমাকে পুলিশসহ সাতটার সময় উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আমার ফ্যামিলি বলে, ওর মোবাইল কোথায়- মোবাইল এখন দিতে হবে। তখন ওরা ভয়ে মোবাইলটি দিয়ে যায় আমার ফ্যামিলির কাছে।
সেখান থেকে বের হয়ে আমি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালে যাই এবং চিকিৎসা নেই। চিকিৎসার পর আমরা থানায় আসি এবং মামলা দায়ের করতে চাই। কিন্তু তারা মামলাটা গ্রহণ করতে চাচ্ছিল না। তারা বলছিল ইনস্টিউটের কর্তৃপক্ষকে জানাতে। সেদিন ছিল শুক্রবার, বন্ধের দিন। তাই কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারছিলাম না।’
‘আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব। তখন আমি ট্যাক্স সদস্যদের ফোন দেই। তারা তখন সাথে সাথেই আসে। আমি ও আমার ট্যাগ মেম্বাররা পুলিশ সদস্যদেরকে বলি, আমরা আপনাদের হয়ে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছি। সেই খাতিরে আমার মামলাটা দয়া করে আপনারা নেন। যখন তারা বুঝতে পারছে আমরা তাদের সাথে সম্পৃক্ত আছি তারা তখন মামলা না নিয়ে অভিযোগ আকারে নেন এবং বলেন ইনস্টিউট প্রশাসনকে অবগত করতে।’
‘পরে, ইন্সটিউট যখন খোলা হয় আমরা তাদেরকে জানাই এবং তারা দুই পক্ষে সবকিছু শুনে আমাকে নির্দোষ বলে জানিয়েছেন। আমাদের কাছে তারা ক্ষমাপ্রার্থী। আমি ভেবেছিলাম, তাদের ক্ষমা করে দিব।’
‘আমি যেহেতু একজন ছাত্র, তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইনি। তারা ছিল লাস্ট ইয়ারের ছাত্র। আমি যখন পদক্ষেপ নিলাম, তখনই শুনি আরেক ছাত্রের সাথে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তার নাম কুরবান। তার গলার উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল চিৎকার করছে তবুও তারা ছাড়েনি। এটা শুনে তখন আমি ভাবলাম, এটা আসলে ক্ষমার যোগ্য না।’
‘পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আবরার, তোফাজ্জল, সাম্যর মতো বিনা অপরাধে আর কারো মা-বোনের বুক যেন খালি না হয়। আমাকেও মারার সময় বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ‘আবরারের কথা মনে আছে?’
‘তখন আমি ভেবে নিয়েছি এটাই আমার শেষ। আমার পরিবার, আমার মা-বোনের সাথে আর কখনো দেখা হবে না।’