এখনো র’হস্যের জট খোলেনি সেই ভ’য়ংকর গু’প্তঘরের

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে তৈরি গুপ্তঘরে শিল্পী খাতুন নামে এক নারী এবং আব্দুল জুব্বার নামে এক বৃদ্ধের বন্দি থাকা এবং সেই গুপ্তঘর নিয়ে রহস্যের জট খোলেনি। এ ঘটনায় থানায় ওই ঘরের মালিক, পল্লী চিকিৎসক নাজমুল ইসলাম আরাফাতসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে পৃথক মামলা করা হয়েছে।

মামলার প্রধান আসামি নাজমুল ইসলাম আরাফাতকে জিজ্ঞাসাবাদের পর শনিবার (৩ মে) বিকেলে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। আরাফাত পশ্চিম লক্ষীকোলা গ্রামের মৃত রেজাউল করিম তালুকদারের ছেলে। ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন (৩৮) চান্দাইকোনা ইউনিয়নের লক্ষিবিষ্ণুপ্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী ও আব্দুল জুব্বার (৭৫) একই ইউনিয়নের পূর্বপাইকড়া গ্রামের মৃত রুস্তম শেখের ছেলে।

এর আগে শুক্রবার (২ মে) ভোরে রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত সোনারাম গ্রামে দিনমজুর জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গোপন ঘর থেকে মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ পথে বেড়িয়ে আসেন আব্দুল জুব্বার ও শিল্পী খাতুন।

শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে গেছে, সোনারাম গ্রামে জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে গুপ্তঘর দেখতে পাওয়া যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা ইতোমধ্যে ওই গুপ্তঘরটি ভেঙে ফেলায় বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। ঘরটির প্রতিটি কক্ষ এক একটি কবরের সমান। সামনে রয়েছে করিডোর, প্রতিটি কক্ষে প্রবেশের জন্য ছোট ছোট গেইট রয়েছে। ঘরের পূর্ব কোনায় একটি মাটির সুরঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়, যে সুরঙ্গ দিয়ে ওই নারী ও বৃদ্ধ পালিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন।

চান্দাইকোনা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, সোনারাম গ্রামের জহুরুল একজন দিনমজুর। তিনি খুবই হতদরিদ্র। তার ছেলে সুমন হোটেলে কাজ করে। কিছুদিন আগে একটি দুর্ঘটনায় জহুরুলের পা ভেঙে যায়। আমরা গ্রামবাসী চাঁদা তুলে তার চিকিৎসা করাই। হঠাৎ করে তার বাড়িতে ভবন নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সবার মনে সন্দেহ ছিল। আরাফাতের টাকাতেই এ ভবনটি নির্মাণ হয়েছে বলে গ্রামবাসীর ধারণা।

তিনি বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে যেভাবে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায়, সেটি একটি টর্চার সেল। মানুষ ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হতো।

সোনারাম গ্রামের প্রায়ই আড়াই কিলোমিটার দূরে পূর্ব লক্ষীকোলা নাজমুল ইসলাম আরাফাতের গ্রামের বাড়িতে গেলে তার ইরির প্রজেক্টে আরও একটি গুপ্তঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। ভয়ংকরভাবে নির্মিত এ গুপ্ত ঘরেও রয়েছে তিনটি কক্ষ। ভেতরের কোন শব্দ বাইরে যাতে না আসে সে জন্য দুই স্তরের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বোঝা যায় ওই কক্ষগুলো সদ্য নির্মিত। ওই প্রজেক্টের ঘরে এমন গুপ্ত ঘর তৈরির বিষয়টি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি বলে গ্রামবাসীরা দাবি করেন তারা।

স্থানীয়রা জানান, আরাফাত কখনও সাংবাদিকতা, কখনও সমন্বয়কের পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ান। তিনি গ্রাম্য চিকিৎসক হলেও তার কোনো সার্টিফিকেট নেই। তার ভাই নাঈম আহমেদ বাধন সাভারে এনাম মেডিকেলের চিকিৎসক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামের দাপট দেখিয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন। আরাফাতের বিরুদ্ধে মামলাবাজি, চুরি, ব্ল্যাকমেইলসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও গোপন ঘরে কাউকে আটকে রেখে নির্যাতনের বিষয়টি কারও জানা ছিল না।

জুয়েল রানা নামে একজন বলেন, আরাফাত মানুষকে অপহরণ করে এনে এ গোপন ঘরে আটকে রাখে এবং চক্রটি কিডনি পাচারের সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারেন বলে দাবি করেন জুয়েল।

ভুক্তভোগী শিল্পী খাতুন বলেন, প্রায় ৬ মাস আগে আমাকে তুলে নিয়ে যায় আরাফাত। এরপর হাত-পা বেঁধে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে প্রায় ৪ মাস আগে ওই গোপন ঘরটিতে রাখে। সেখানে আগে থেকেই ওই বৃদ্ধকে রাখা হয়েছিল। আরাফাত তাদেরকে মেরে কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির কথাও বলেছিল। বৃদ্ধ জুব্বারের পায়ে একটি ক্ষত ছিল, সেই ক্ষত ড্রেসিং করার জন্য ভেতরে একটি কেচি রেখে যায় আরাফাত। সেই কেচি দিয়ে ৪/৫ দিন ধরে সুরঙ্গ তৈরি করে বের হই আমরা।

বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বার বলেন, আমার কাছ থেকে ৮ বিঘা সম্পত্তি লিখে নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে। সম্পত্তি লিখে না দেওয়ায় ব্যাপক নির্যাতন করেছে। গোপন ঘরে তাদের দিনে একবার খেতে দেওয়া হতো। গোসলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক। ওই দুই বৃদ্ধ ও নারী সেখানে ৫/৬ মাস সেখানে কীভাবে ছিলেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভবনটি দেখেও ছয় মাসের পুরোনো মনে হয় না। আবার গুপ্তঘরটি তৈরি হয়েছে সেটিও সঠিক। কোনো অপরাধের উদ্দেশ্য নিয়েই ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে।

জানা যায়, ৬ মাস আগে শিল্পী খাতুন নিখোঁজ হওয়ায় তার স্বামী মো. মনছুর বাদী হয়ে নাজমুল ইসলাম আরাফাত ও শরীফ মেম্বারসহ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। এদিকে একই সময়ে বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় জিডি করেন তার ছেলে। গত শুক্রবার ভোররাতে সোনারাম গ্রামের জহুরুল ইসলামের বাড়িতে নির্মাণাধীন ভবনের গুপ্ত কক্ষে বন্দী থাকার পর কেচি দিয়ে মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ তৈরি করে মুক্ত হন তারা।

রায়গঞ্জ থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় শিল্পী খাতুনের স্বামী মনছুর রহমান বাদী হয়ে একটি এবং বৃদ্ধ আব্দুল জুব্বারের ছেলে শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আরাফাতকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আগামীকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে রিমান্ড আবেদন করা হবে।

তিনি বলেন, ঘটনার প্রকৃত রহস্য এখনো উদ্‌ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে সোনারাম গ্রামে ভবনের নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড কক্ষ পাওয়া গেছে। প্রতিটি কক্ষ মাত্র ৪ ফুট উঁচু দৈর্ঘ্য ৯ ফুট এবং প্রস্থ ৪ ফুট।

সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. জিয়াউর রহমান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আমরা তেমন কিছু পাইনি। আসামি একজন ধরা পড়েছে, তাকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়েছে। রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে যদি কোন কিছু পাওয়া যায়। আর আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্তে যেটা আসে দেখা যাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *