
বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় মধ্যযুগীয় পান্ডুলিপির নাম কোডেক্স গিগাস, যার অর্থ ‘বিশাল গ্রন্থ’। তবে এটি বেশি পরিচিত The Devil’s Bible বা শয়তানের বাইবেল নামে। প্রায় ৮০০ বছর পুরনো এই বইটি ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী এবং ধর্মতত্ত্ববিদদের জন্য এক বিস্ময়কর ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধারণা করা হয়, আনুমানিক ১২১০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের পূর্বাঞ্চলের একটি বেনেডিক্টাইন মঠে বইটি রচিত হয়েছিল। বইটির ওজন প্রায় ৩৬ কেজি এবং এতে রয়েছে ৬২০টি পৃষ্ঠা। পৃষ্ঠাগুলি সাধারণ কাগজে নয়, বরং চামড়ায় লেখা। গবেষকদের মতে, এই বই তৈরি করতে অন্তত ১৬০টি গাধার চামড়া ব্যবহার করা হয়েছে।
বইটিতে পুরাতন ও নতুন নিয়ম (Old & New Testament) ছাড়াও রয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, চিকিৎসা, ব্যাকরণ, ইতিহাস এবং ভূত তাড়ানোর মত বিষয়ের বিবরণ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ হলো ৫৭৭ নম্বর পৃষ্ঠা, যেখানে একটি পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে আঁকা রয়েছে শয়তানের চিত্র। এই চিত্রের ভয়াবহ রূপ, নিঃসঙ্গ পরিবেশ ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কাহিনিগুলো বইটিকে করে তুলেছে আরও রহস্যময়।
একটি জনশ্রুতি অনুসারে, একজন সন্ন্যাসী গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলে নিজের প্রাণ বাঁচাতে এক রাতেই এই বইটি লেখার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু অসম্ভব কাজ দেখে তিনি শয়তানের সহায়তা চান এবং নিজের আত্মার বিনিময়ে বইটি শেষ করার প্রস্তাব দেন। যদিও ইতিহাসবিদরা একে নিছক লোককথা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, তবে বইটির একটি বিষয় তাদেরও হতবাক করেছে— এটি সম্পূর্ণ একক হাতে লেখা। লেখার শৈলী, কলমের চাপ, অক্ষরের বিন্যাস এবং লাইনের উচ্চতা বইজুড়ে একদম অভিন্ন, যেন একটি প্রিন্টারে ছাপানো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বই সম্পূর্ণ লিখতে একজন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার ও শিল্পীর কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ বছর সময় লাগার কথা। তবুও বইজুড়ে কোথাও হাতের লেখায় ক্লান্তি বা পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই।
বইটি একাধিকবার মালিক পরিবর্তন করেছে। ১৫৯৪ সালে এটি রোমান সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফের সংগ্রহে গেলে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সিংহাসনচ্যুত হন। ১৬৪৮ সালে সুইডিশ বাহিনী যখন প্রাগ দখল করে, তারা এটি নিয়ে যায়। এরপর সুইডিশ রাজপরিবারেও নানা দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঘটতে থাকে।
১৮৭৭ সালে সুইডেনের রাজপ্রাসাদে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বহু মূল্যবান বই পুড়ে গেলেও কোডেক্স গিগাস অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়। কেউ কেউ বলেন, বইটি স্পর্শ করলেই নানান অঘটন ঘটে— কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, কেউবা প্রাণ হারান।
এই রহস্যময় বই নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু গবেষণা ও ডকুমেন্টারি। ২০০৮ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একে বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় মধ্যযুগীয় পান্ডুলিপি হিসেবে অভিহিত করে। বর্তমানে বইটি সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত। জনসাধারণের জন্য এটি সরাসরি উন্মুক্ত নয়, তবে ২০০৭ সালে এটি ডিজিটাল আকারে প্রকাশ করা হয়, যাতে গবেষকরা অনলাইনে এর অধ্যয়ন করতে পারেন।
তথ্যসূত্রঃ https://youtu.be/u2aHhVGfC9Q?si=IyoUUrJYLGG8bpRT