
১১৭ দিনের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে রাত পোহালেই। লন্ডনে দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে আগামীকাল মঙ্গলবার দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তার এ ফেরা নিয়ে দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বসাধারণের মধ্যেও বিরাজ করছে উৎসাহ-উচ্ছ্বাস। এমনকি গত কদিন ধরে গুলশানে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘ফিরোজা’ও প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেখানে চলছে ধোয়ামোছা আর সাজসজ্জার কর্মযজ্ঞ।
এছাড়া প্রিয় নেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে বিএনপির পক্ষ থেকে নানামাত্রিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। বিশেষত, পুত্রবধূ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমানের দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফেরা খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার খবরে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। জুবাইদার এ প্রত্যাবর্তনে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্যরকম চাঙ্গা ভাব বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমানও দেশে ফেরার পথে খালেদা জিয়ার সঙ্গী হচ্ছেন। যদিও বিগত বছরগুলোতে শামিলা রহমান বিভিন্ন সময়ই দেশে অবস্থান করেছেন। সেদিক থেকে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশত্যাগের পর এবারই প্রথম দেশে ফিরতে পারছেন জুবাইদা।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, লন্ডনের গ্রিনিচ সময় সোমবার বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির দেওয়া বিশেষ রাজকীয় বিমানে (আধুনিক এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে) ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তার এ প্রত্যাবর্তন যেন শুধু একজন রাজনীতিকের ফেরা নয়, এক যুগান্তকারী মুহূর্তের সূচনা—এমনটিই মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
ধোয়া-মোছা আর সাজসজ্জায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ও এখন জ্বলজ্বল করছে। সন্ধ্যা নামার আগমুহূর্তে বাসভবনের ভেতরে-বাইরে জ্বলে উঠছে অসংখ্য বাতি। এ যেন দলের নেতাকর্মীদের কাছে প্রিয় নেত্রীর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফেরারই আশার আলো।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রিয় নেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ম্যাডাম মঙ্গলবার সকাল ১০টায় কাতার রয়েল অ্যাম্বুলেন্সের বিমানযোগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। আমরা আশা করছি, তিনি সময়মতো পৌঁছাবেন।’
শিক্ষার্থীদের সম্মানে নীরব পথে অভ্যর্থনা
খালেদা জিয়ার দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কে, এমনকি পুরো ঢাকা শহরে কয়েক লাখ নেতাকর্মীর সমাগম ঘটতে পারে। একই দিন এসএসসি পরীক্ষা থাকায় সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের যেন কোনো ধরনের ভোগান্তি পোহাতে না হয় সেদিকে আন্তরিক নজর রাখতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেছেন, ‘আমরা অনুরোধ করছি, কেউ যেন রাস্তার ওপর না দাঁড়ান। ফুটপাতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে যেন অভ্যর্থনা জানান। পরীক্ষার্থীদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।’
পুলিশ ও ট্রাফিক কর্তৃপক্ষকেও এ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
এরই মধ্যে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার খবরে বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন পর্যন্ত সড়কে অতিরিক্ত জনসমাগমের সম্ভাবনা থাকায় সুষ্ঠু ট্রাফিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ডিএমপি বলছে, অতিরিক্ত যানজট এড়ানোর লক্ষ্যে ৬ মে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। সব আন্তঃনগর ট্রেন টঙ্গী, এয়ারপোর্ট এবং তেজগাঁও স্টেশনে দুই মিনিটের জন্য থেমে যাত্রী বহনের ব্যবস্থা করবে। এছাড়া হজযাত্রীসহ বিদেশগামী যাত্রীদের এয়ারপোর্টে গমনাগমনের ক্ষেত্রে এবং ওই এলাকায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় নিয়ে বাসা থেকে বের হতে অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি।
প্রস্তুত ফিরোজা, জ্বলে উঠছে সব বাতি
গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িটি—‘ফিরোজা’—এরই মধ্যে প্রস্তুত। চারদিকের দেয়াল, সামনের নিরাপত্তা বাহিনীর কক্ষ, সিএসএফ ও পুলিশের টহল—সবকিছুই পরিপাটি। বাড়ির প্রতিটি কক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আঙিনায় ফুলের টব, বিদ্যুৎ-গ্যাস-ওয়াসা—সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেছেন, ‘ম্যাডামের বাসা পুরোপুরি প্রস্তুত। আমরা সবাই এখন তার আগমনের প্রতীক্ষায় আছি।’
পাশে থাকবেন পরিবার ও চিকিৎসক দল
লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকবেন দুই পুত্রবধূ—জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান। লন্ডনে অবস্থানরত ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে দোহায় যাত্রাবিরতির পর ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন ম্যাডাম (খালেদা জিয়া)।
তিনি বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) আগের চেয়ে ভালো আছেন। তারেক রহমান নিজে গাড়ি চালিয়ে ম্যাডামকে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবেন। দেশবাসীর দোয়া চাই, যেন শান্তিপূর্ণভাবে তিনি ফিরে আসতে পারেন।’
‘ফিরোজা’য় মেডিকেল প্রস্তুতি
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের জটিলতা বিবেচনায় রেখে তার গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় বিশেষ মেডিকেল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তার আগমন ঘিরে বাসাটি একটি আধুনিক ও জরুরি চিকিৎসা সুবিধাসম্পন্ন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়েছে, যেন কোনো প্রকার স্বাস্থ্য সংকটে দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়।
শেষের কথা নয়, শুরুর এক প্রহর
উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ৪৬ মিনিটে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন খালেদা জিয়া। পরদিন বাংলাদেশ সময় বিকেল ২টা ৫৮ মিনিটে লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে অবতরণ করে খালেদা জিয়াকে বহনকারী রয়েল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি। এরপর তাকে সেখান থেকে সরাসরি ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ নিয়ে ভর্তি করা হয়। ১৭ দিনের ক্লিনিক-পর্ব শেষে তাকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি শেষে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরা যেন শুধু একজন রাজনীতিকের প্রত্যাবর্তন নয়, বরং এক ইতিহাসের পুনর্জন্ম। শেষের কথা নয়, যেন শুরুর এক নতুন প্রহর।
সোমবার সন্ধ্যার আগে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অপেক্ষার প্রহর প্রায় শেষ, তবুও ফিরোজার অপেক্ষার অধীরতা যেন শেষই হচ্ছে না। খালেদা জিয়ার জন্য পথ চেয়ে থাকা ফিরোজার যেন আর তর সইছে না। সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়িটির সব বাতি জ্বলে উঠেছে। নেতাকর্মীদের হৃদয়ে বাজছে প্রত্যাবর্তনের ঘণ্টা। প্রিয় নেত্রীর এ ফেরাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির আকাশে আবারও ভেসে বেড়াচ্ছে অজস্র আশা, সম্ভাবনা ও নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্ন, বলছেন দলের নেতাকর্মীরা।