
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বুধবার (২১ মে) চিঠি দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের ৪৩ সিনেটর ও এমপি।
মোটা দাগে তিনটি ইস্যুকে সামনে আনা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- জরুরি ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা, জুলাই অভ্যুত্থানের ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার করা এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ভেঙে ফেলা।
এসব কাজ করতে বিলম্ব বা অস্পষ্টতা কেবল জনসাধারণের অবিশ্বাসকে আরও গভীর করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করবে। বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা আপনার নেতৃত্বকে সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। গণতান্ত্রিক বৈধতা পুনরুদ্ধারের দিকে এই অপরিহার্য পদক্ষেপকে সমর্থন করার জন্য আমরা গঠনমূলকভাবে জড়িত হতে প্রস্তুত। ই-মেইল বার্তার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে, যা বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মো. রাশেদুল হক নিশ্চিত করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি কালবেলার হাতেও এসেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে- আমরা, নিম্নস্বাক্ষরকারী অস্ট্রেলিয়ান সিনেটর এবং সংসদ সদস্যরা, ‘নির্বাচিত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণকে সমর্থন করার জন্য আমাদের প্রত্যাশা ভাগাভাগি করতে চাই। সেজন্য অবিলম্বে নির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রদান, জুলাই অভ্যুত্থানের ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রদান এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচারকে সমর্থন করার জন্য আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তারা বলেন, গত বছর জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের জনগণের দেখানো সাহসিকতা এবং সাহসকে স্বীকৃতি জানাই। এটি আপনার প্রশাসনকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার এবং শাসনব্যবস্থার উপর জনসাধারণের আস্থা পুনর্নির্মাণের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টের সিনেটর ও এমপিরা বলেন, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা এবং একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনি প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের গত তিনটি নির্বাচনে একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈধতা ছিল না। নির্বাচনি অখণ্ডতা পুনরুদ্ধার এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য আমরা আপনার সরকারকে অনুরোধ করছি :
‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অবাধ, সুষ্ঠু এবং আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের জন্য একটি স্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশ সম্প্রদায় আমাদের জানিয়েছে যে, তারা আশা করে, এই ক্যালেন্ডার বছরে এটি ঘটবে এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। নির্বাহী ব্যবস্থার ব্যবহার এবং অযাচিত প্রভাব বা দমন রোধ করতে হবে।’
ড. ইউনূসকে নিয়ে লেখা চিঠিতে বলা হয়, আমরা আশা করি বাংলাদেশ এই পরিবর্তনগুলো অন্তর্ভুক্ত করবে, আপনার সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়ন করবে এবং বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের বন্ধু এবং অংশীদার হিসাবে তার ন্যায়সঙ্গত স্থান গ্রহণ করবে। বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষের মতো আমরাও বাংলাদেশের ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিকদের সাহসিকতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি যারা জুলাই বিপ্লব ঘটাতে পেরেছিলেন। তবে, এই বিজয় এসেছে বিশাল মানবিক মূল্যে।
আরও বলা হয়- হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রয়টার্স এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, বিগত সরকারের বছরের পর বছর ধরে নির্মম দমনে হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আমরা একাধিক আবেদন পেয়েছি। আমরা অনুরোধ করছি যে, আমরা আপনার সরকারকে স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং বিচারের মাধ্যমে অতীতের রাজনৈতিক সহিংসতার অপরাধের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করার জন্য অনুরোধ করছি। তারা ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য সত্য, ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণের একটি প্রক্রিয়াও দাবি করেছে। আমরা এই আহ্বানের শক্তি এবং মানবিকতা স্বীকার করি।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) অবিলম্বে ভেঙে ফেলা প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়, মানবাধিকার পর্যালোচনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতনসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০০৯ সাল থেকে র্যাব কর্তৃক ২,৬৯৯ জনেরও বেশি মানুষকে বেআইনিভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং বাহিনীটি সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সাথে কাজ করেছে, মতবিরোধকে চুপ করিয়েছে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের লক্ষ্য করে কাজ করেছে।
আমরা র্যাবের নেতৃত্বের উপর মার্কিন সরকার কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলোকে সমর্থন করে উল্লেখ করেছি এবং আমরা অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। আবারও আমরা লক্ষ্য করছি অস্ট্রেলীয় বাংলাদেশ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আপনার প্রশাসনের কাছে র্যাব ভেঙে ফেলার এবং এর শিকারদের ন্যায়বিচার প্রদানের অনুরোধ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে আরও বলা হয়, আমরা আপনার প্রশাসনকে অবিলম্বে এবং জনসমক্ষে একটি নির্দিষ্ট, সময়সীমাবদ্ধ নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করার আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য এটি একটি জরুরি এবং আলোচনার অযোগ্য পদক্ষেপ।
অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টের যেসব সিনেটর ও এমপি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তারা হলেন- সিনেটর লারিসা ওয়াটার্স, সিনেটর ডেভিড শোব্রিজ, সিনেটর জর্ডন স্টিল-জন, সিনেটর ফাতিমা পেম্যান, সিনেটর লিডিয়া থর্প, সিনেটর পেনি অলম্যান-পেইন, সিনেটর মেহরিন ফারুকি, সিনেটর স্টেফ হজগিন্স-মে, সিনেটর বারবারা পোকক, সিনেটর পিটার হুইশ-উইলসন, সিনেটর, ডোরিন্ডা কক্স, সিনেটর নিক ম্যাককিম, সিনেটর সারা হ্যানসন-ইয়ং, এলিজাবেথ ওয়াটসন-ব্রাউন এমপি, অ্যাবিগেল বয়েড (এনএসডব্লিউ এমএলসি), আমান্ডা কোহন, ক্যাথরিন কোপসি, (এমএলসি), সু হিগিনসন (এনএসডব্লিউ এমএলসি), কেট ফেহরম্যান (এনএসডব্লিউ এমএলসি), আনাসিনা গ্রে-বারবেরিও (এমএলসি), আইভ পুগলিয়েলি (এমএলসি), ড. সারাহ ম্যানসফিল্ড (এমএলসি), ব্র্যাড পেটিট (এমএলসি), জেনি লিওং (এনএসডব্লিউ এমপি), তামারা স্মিথ (এনএসডব্লিউ এমপি), কোবি শেট্টি, (এনএসডব্লিউ এমপি), টিম রিড এমপি, এলেন স্যান্ডেল এমপি, মাইকেল বার্কম্যান এমপি, গ্যাব্রিয়েল ডি ভিয়েট্রি এমপি, ড. রোজালি উডরাফ এমপি, তাবাথা ব্যাজার এমপি, সিসিলি রোজল এমপি, ক্যাসি ও’কনর এমএলসি, ভিকা বেইলি এমপি, হেলেন বার্নেট এমপি, শেন র্যাটেনবারি এমএলএ, অ্যান্ড্রু ব্র্যাডক এমএলএ, জো ক্লে এমএলএ, লরা নাটাল এমএলএ, রবার্ট সিমস এমএলসি এবং ড. মাইক ফ্রিল্যান্ডার এমপি।